শনিবার, ১২ এপ্রিল ২০২৫, ০২:৫৪ অপরাহ্ন

হাজারো জনতার ভীড়ে আবু সাঈদকে খুঁজে ফিরছেন পিতা

Reporter Name / ১০০ Time View
Update : সোমবার, ২৬ আগস্ট, ২০২৪

ছাত্র গণঅভ্যুত্থানের সময় পুলিশের গুলিতে নিহত ছেলে আবু সাঈদকে যেন বিভ্রমের মাঝেই খুঁজে ফিরছেন বাবা মকবুল হোসেন। রংপুরের বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের নিহত এই শিক্ষার্থীর কবরে দল-মত, পেশা, জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে হাজার হাজার মানুষ প্রতিনিয়ত শ্রদ্ধা নিবেদন এবং তার বিদেহী আত্মার মাগফেরাত কামনা করে চলেছে।
ছেলের মৃত্যুশোকে মকবুল হোসেন মর্মাহত, হতবিহ্বল ও বাকরুদ্ধ হয়ে পড়েছেন। ছেলের কবরের পাশেই কেটে যায় তার সারাটা দিন। কেবল পাঁচ ওয়াক্ত নামাজের সময় মসজিদে নামাজ পড়তে যান, ছেলের জন্য দুহাত তুলে দোয়া করেন। ন্যায়ের জন্য জীবন বিসর্জন দিয়েছেন, পুলিশের গুলির সামনে দুই হাত প্রসারিত করে বুক পেতে দিয়েছেন। এক হাতে লাঠি নিয়ে অন্যায়ের প্রতিবাদ করা সাঈদ আজ ইতিহাসে ঠাঁই করে নিয়েছেন।
বাসসের সাথে আলাপকালে মকবুল হোসেন তার ছেলের মৃত্যুর জন্য টার্গেট কিলিংকে দায়ী করেন। যেহেতু সাঈদ মিডিয়ায় সাক্ষাৎকার দিয়েছিলেন সে কারণেই তাকে হত্যার লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত করা হয়।
তিনি বলেন, ‘সাঈদ অফিসার হওয়ার স্বপ্ন দেখতেন। পঞ্চম শ্রেণিতে অধ্যয়নরত সাঈদ বৃত্তি লাভ করেন। তিনি অত্যন্ত মেধাবী ছিলেন। রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষাতেও দ্বিতীয় স্থান অধিকার করেন।’
সাঈদের কথা বলতে গিয়ে কান্নায় ভেঙে পড়ে মা মনোয়ারা বেগম বলেন, ‘আমার  এখনও বিশ্বাস হতে চায় না যে সাঈদ আর বেঁচে নেই। আমার সবসময়ই মনে হয় হয়, সে ছাত্রাবাসে না হয় কলেজে রয়েছে। যে কোন সময় বাড়ি ফিরেই আমাকে মা বলে ডাক দেবে।’
গত ঈদের কথা মনে উঠলেই তার মন ভারক্রান্ত হয়ে পড়ে, নিজের টিউশনির টাকা বাঁচিয়ে সাঈদ গত ঈদে সবার জন্য উপহার নিয়ে বাড়ি ফিরেছিলেন।
‘মাটির ঘরে থাকতে সমস্যা হয় সেজন্য সাঈদ আমাদের জন্য ইটের ঘর তুলে দিয়েছিল। ঘরের যে দিকে তাকাই শুধু সাঈদেরই স্মৃতি,’ বলেন মনোয়ারা বেগম।
সাঈদের বিলাপরত ছোট বোন সুমী খাতুন বলেন, তার ভাই একজন বড় অফিসার হতে চেয়েছিল। সুমী বলেন, ‘আমার ভাই বলতো আমাদের সব দুঃখ-দুর্দশা দূর করে দেবে। আজ আমার ভাইয়ের কবর জিয়ারত করতে অনেক গণ্যমান্য লোকজন আসেন, তারা তাঁর জন্য দোয়া করেন। আমাদের কষ্ট হয় তবুও ভাইয়ের জন্য আমরা গর্বিত।’
তিনি কর্তৃপক্ষের কাছে তার ভাইয়ের নামে প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি করে হল নির্মাণের দাবি জানান। পীরগঞ্জে একটি পৃথক বিশ্ববিদ্যালয় ও হাসপাতাল নির্র্মাণের ও দাবি জানান, যেখানে বিনামূল্যে চিকিৎসাসেবা প্রদান করা হবে।
পীরগঞ্জের বাবনপুর নামক প্রত্যন্ত পল্লীর এক দরিদ্র পরিবারে আবু সাঈদের জন্ম । ৯ ভাই-বোনের সংসারে কেবল তারই পড়াশোনা চালিয়ে যাওয়া সম্ভব হয়। তিনি বেগম রোকেয়া বিশ^বিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের ১২তম ব্যাচের ছাত্র ছিলেন।
মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিকে লেখাপড়া চালিয়ে যেতে আত্বীয় স্বজন ও প্রতিবেশীরাও সাহায্য করেছে। আবু সাঈদকে নিয়ে হাজারও স্বপ্ন দেখতেন বাবা-মা। পড়াশোনা শেষ করে ছেলে একদিন তাদের দুঃখের সংসার আনন্দে ভরিয়ে দেবে। তবে হঠাৎই সব স্বপ্ন ভেঙে চুরমার হয়ে যায়। গত ১৬ জুলাই সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কার আন্দোলন চলাকালে পুলিশের গুলিতে বুক পেতে দিয়ে নিহত হন আবু সাঈদ, সৃষ্টি করেন আত্মত্যাগ ও সাহসিকতার এক অনন্য নজির। সেদিন সারাদেশে পুলিশের গুলিতে আরও ছয়জন নিহত হয়।
তাঁদের মৃত্যু কোটা সংস্কার আন্দোলন তীব্র ও বেগবান হয়। সারাদেশে আইন শৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনী পুলিশ, বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি) ও র‌্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ান (র‌্যাব) সদস্যরা আন্দোলনকারীদের ওপর নির্মম আক্রমণ চালায়। কিন্তু আন্দোলন দমানো যায়নি, বরং আরও প্রবল আকার ধারণ করে। এক পর্যায়ে এ আন্দোলন শেখ হাসিনার পতনের এক দফা দাবিতে পরিণত হয় এবং পরিশেষে এটি ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানের রূুপ নেয়, যাতে শেখ হাসিনা পদত্যাগ করে দেশ ছেড়ে পালিয়ে যেতে বাধ্য হন।
সাঈদের কথা বলতে গিয়ে সহপাঠী আরমান হক ও লিয়াকত আলী জানান, ভদ্র ও নম্্র স্বভাবের আবু সাঈদ শিক্ষক ও সহপাঠীদের অত্যন্ত প্রিয় ছিল। সব বিভাগের সবার সাথে আবু সাঈদের সম্পর্ক ভালো ছিল, সে কোনো বিশেষ রাজনৈতিক দলের সাথে সরাসরি যুক্ত ছিল না, প্রথমবর্ষ থেকেই সে চাকুররি জন্য পড়াশোনা করতো।
বেগম রোকেয়া বিশ^বিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের বিভাগীয় প্রধান ও সহযোগী অধ্যাপক আসিফ আল মতিন বলেন, ‘ছাত্র সবাই, তবে কিছু কিছু ছাত্র এমনভাবে মন জয় করে নেয়, তাদের ভোলা যায় না, তেমনি একজন ছাত্র ছিল আবু সাঈদ।’
আবু সাঈদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন ও কবর জিয়ারত করতে এসে ১৪ আগস্ট বিএনপি’র মহাসচিব মীর্জ ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, আবু সাঈদের কারণে পীরগঞ্জের মাটি এখন ইতিহাসে স্থান পেয়েছে, আবু সাঈদ বুকের রক্ত দিয়ে বাংলাদেশে এক নতুন ইতিহাস রচনা শুরু করেছে।
তিনি বলেন, সেই ইতিহাস হচ্ছে তরুণদের আত্মত্যাগের ইতিহাস, নতুন স্বাধীনতার ইতিহাস,  বাংলাদেশের মানুষকে নতুন করে স্বৈরাচার মুক্ত করবার ইতিহাস।
এর আগে ১০ আস্ট অন্তবর্তী সরকারের প্রধা নোবেল বিজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূস আবু সাঈদের কবর জিয়ারতে এসে বলেন, ‘আবু সাঈদ কারও একার নয়, গোটা বাংলাদেশের। ঘরে ঘরে লাখো আবু সাঈদ জন্মাবে।’
ড. মুহাম্মদ ইউনূস আরো বলেন, ‘আবু সাঈদ এখন এক পরিবারের সন্তান না। বাংলাদেশের যত পরিবার আছে, তাদের সন্তান। যারা বড় হবে, স্কুল-কলেজে পড়বে, তারা আবু সাঈদের কথা জানবে এবং নিজে নিজেই বলবে, আমিও ন্যায়ের জন্য লড়ব। আবু সাঈদ এখন ঘরে ঘরে।


আপনার মতামত লিখুন :

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

More News Of This Category
এক ক্লিকে বিভাগের খবর